লেখক : উন্মেষ মিত্র
দীপদার মত দু-এক পিস মানুষ বা মতান্তরে মনুষ্যেতর প্রাণী আছে বলেই আমাদের মত নিরীহ,গোবেচারা,সরল-সাধাসিধে ছেলেরা পাতি বাংলায় যাকে 'কেস' বলে,সেটাই হজম করতে বাধ্য হয়।কারণে অকারণে বিভিন্ন জায়গায় এই দীপদার জন্য যে আমরা গণপিটুনি খেতে খেতে বেচে গিয়েছি তা কেবল আমরাই জানি।আমরা বলতে আমি,তুতুয়া,বিশাল আর লাল্টু।লাল্টু অবশ্য মাঝেসাঝে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছে,তবুও দীপদার গুলবাজি বা ওই 'কেস' খাওয়ানোর স্বভাব ঘোচেনি,এমনকি সুদূর ভবিষ্যতেও এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশাও আমরা ত্যাগ করেছি।
সেবার যেমন তুতুয়াদের বাড়ি কীসের একটা নিমন্ত্রণ ছিল,এমনি ঘরোয়া অনুষ্ঠান।আমরা ৪ বন্ধু আর তুতুয়ার বাবার অফিসের কয়েকজন সহকর্মীর ফ্যামিলি আমন্ত্রিত।এমনি কথাবার্তা চলছে,সহকর্মীদের মধ্যে ঘোষ বাবুর নাকি খুব জঙ্গলে ঘোরার শখ।তো এবার ফ্যামিলি নিয়ে পরের সপ্তাহের ছুটিতে সারান্ডার জঙ্গলে যেতে চান কিন্তু সেখানে নাকি কোনো থাকার জায়গার খোঁজ পাচ্ছেন না।SAIL এর গেস্টহাউসটা নাকি পুরো ভর্তি।ভদ্রলোক খুব মনমরা হয়ে কথা গুলো বলছিলেন।দীপদা একটু দূরে বসে কফি খাচ্ছিল হটাৎ গলা খাকরানি দিয়ে বলে উঠল,"কেন রাম সিং আছে তো।" ভদ্রলোক অবাক হয়ে দীপদার দিকে তাকিয়ে বললেন,"কে রাম সিং?"দীপদা কফি তে আরেকচুমুক দিয়ে বলল,"এককালে জমিদার ছিলেন,এখন তো আর সেসব নেই,বিশাল জমিদার বাড়ি,ঘর ভাড়া দেন,আর আমি বললে না করতে পারবেন না।" ভদ্রলোক যেন বিগলিত হয়ে পড়লেন,"বাঁচালে ভাই,তা ফোন নম্বরটা একটু পাওয়া যাবে?" দীপদা একটু চুকচুক করে উঠল,"নাহ!নাহ উনি একেবারে অন্য ঘরানার মানুষ,ওসব ফোন-টোন ব্যবহার করেন না।"ভদ্রলোক একটু কেমন নেতিয়ে গেলো।দীপদা আবার শুরু করল,"তবে চিন্তা করবেন না,আপনার ব্যবস্থা চাইলে হয়ে যাবে।আমার সাথে উনার আলাদা খাতির।আপনার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠালে আপত্তি করতে পারবেন না।"ভদ্রলোক যেন হাতে চাঁদ পেলেন,"কি যে উপকার করলে ভাই,তুমি না থাকলে..." তারপর দীপদাদা খসখস করে চিঠি লিখতে বসে গেলো,তারপর টেরিয়ে একটা সই করল নীচে।তুতুয়া কি একটা বলতে যাচ্ছিল,মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ওকে সরিয়ে ঘোষবাবু কে "সিং মহল" এ যাওয়ার রাস্তা বোঝাতে লাগল,তারপর পইপই করে বলে দিল খবরদার গুগল ম্যাপ দেখতে যাবেন না আমি সব লোকাল নাম বললাম,গুগল ম্যাপ দেখলে সব গুলিয়ে গ হয়ে যাবে।
যাইহোক ঘোষবাবু তো খুব খুশি খাওয়ার সময় দীপদার প্রতি কি গদগদ ভাব কাকিমা মাংস দিতে এলে দীপদাকে দেখিয়ে বলছে,"বৌদি ওই ছেলেটা কে দিন,এরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ,এরা খাবে না তো কারা খাবে।"দীপদাও দেখলাম রসিয়ে রসিয়ে প্রসংসা উপভোগ করছে।
তারপর দিন দশ কেটে গেছে ঠেকে বসে আমরা আড্ডা মারছি দীপদা তখনও আসেনি হটাৎ তুতুয়া হন্তদন্ত হয়ে হাজির।ধাপিতে ধপ করে বসে বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল,"নাহ!দীপদার জন্য আর আমার কোনো মান-সম্মান থাকল না।" বিশাল বিড়িতে শেষটান দিয়ে জ্বলন্ত টুকরোটা পিছনে ছুঁড়ে ফেলে বলল,"কেন কি আবার হল?" তুতুয়া আরও তেরিয়া হয়ে বলল,"কি হয়েছে মানে?আমার সম্মান টা তো আগেই গেছে এবার বাবারটাও গেলো।" লাল্টু চায়ের ভাঁড়টা ধাপি তে রেখে বলল,"কি কেস আবার?"
"কেস মানে?একেবারে সুটকেস।ঘোষবাবু একটু আগে ফোন করেছিলেন রাম সিং,জমিদার বাড়ি এসব নির্ভেজাল গুল ছাড়া আর কিছুই নয়।" আমরা সবাই প্রায় একসাথে "মানে?" বলে চীৎকার করে উঠলাম।
"তবে আর বলছি কি!ঘোষকাকুরা কাল রাতে বড়জামদা স্টেশনে নামে তারপর দীপদার পথনির্দেশ মত গাড়ি ভাড়া করে চলতে থাকে।কিন্তু কিছুদূর এগোনোর পর বুঝতে পারেন কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।কারণ যেসব জায়গার ল্যান্ডমার্ক দেওয়া ছিল গাড়ির ড্রাইভার সেসব জায়গার নাম বাপের জন্মে শোনেনি।ছিঃ ছিঃ ঘোষকাকু কে কীসব উদ্ভট নামের ল্যান্ডমার্ক দিয়েছিল মালটা-হিসুকাঁথা,লালহাগা ইশ!তারপর কাকু ড্রাইভারকে রাম সিং,সিং মহলের কথা জিজ্ঞেস করেন।ড্রাইভার নাকি বলে,'বাবু ইহা পার উস নাম সে কো ই জামিনদার কাভি নাহি থা,জরুর কোই আপকো বুরবক বানায়া।'ওখানে আর কোনো হোটেল,গেস্ট হাউস কিছু নেই।ঘোষ কাকু বোঝেন তিনি 'কেস খেয়েছেন' কিন্তু বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।আর উপায় না দেখে আবার স্টেশনে ফিরে এসে সারারাত প্ল্যাটফর্মে মশার কামড় খেয়ে পরদিন সকালের ট্রেনে জেনারেল কামরায় ঠাসাঠাসি করে কোলকাতা ফেরত।"
আমরা সবাই হাঁ!এত সাবলীল ভাবেও কেউ গুল মারতে পারে! তুতুয়া তখনও বলে চলেছে,"আমি শুধু ঘোষ কাকুর কথা ভাবছি,কাকিমা যা জাঁদরেল মহিলা এসবের পর যা ধাতানি দিয়েছে তা ভেবেই শিউরে উঠছি।তারপর শেষে যা বললেন..."
বিশাল বলল,"আর কি?"
বলে কিনা,"ছিঃ তুতুয়া তুমি এত থার্ড ক্লাস ছেলেদের সাথে মেশ আমার জানা ছিল না।একটার উদাহরণ তো পেলামই,এই ছেলে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে দিতে পারে,আর বাকি তিনটের একেকটা যদি পকেটমার,ড্রাগ অ্যাডিক্ট,তোলাবাজ হয় তাহলেও আমি অবাক হব না।" আমরা চুপ!একটা মনুষ্যেতর জন্তুর জন্য বাকিদের মান-সম্মান কীভাবে ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে পারে এর থেকে বড় উদাহরণ আর বোধহয় হতে পারে না।
দীপদা সেদিন আড্ডায় আসেনি পরে দীপদাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল , “আরে ভেঁতো বাঙালী বেড়াতে গিয়ে শুধু ভালো হোটেলে থাকবে, ভালো খাবে এই ধান্দা। জঙ্গলে যাবে, গুহায় থাকবে, ইঁদুর ঝলসিয়ে খাবে, তবে না আসল ট্রাভেলার। আমি এই বাঙালী জাতির এক প্রতিনিধিকে অ্যাডভেঞ্চারের আসল মানে বোঝাতে চাইলাম আর সবাই শুধু শুধু আমায় ভুল বুঝল। হবে না, কিস্যু হবে না।
একটি খারাপ মেয়ে (shortfilm)
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা
- প্রবীর কুন্ডু